বাংলাদেশের অর্থনীতি, কর্মসংস্থান ও খাদ্য নিরাপত্তা কৃষির ওপর নির্ভরশীল। তবে অতিরিক্ত রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার, মাটির উর্বরতা হ্রাস ও কৃষকের ন্যায্যমূল্য না পাওয়া—এসব সংকট মোকাবিলায় কৃষিক্ষেত্রে সংস্কার এখন সময়ের দাবি। বিশেষজ্ঞদের মতে, জৈব প্রযুক্তি ব্যবহার, মাটির স্বাস্থ্য সুরক্ষা, ডিজিটাল কৃষি সম্প্রসারণ এবং কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা ছাড়া টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়।
অযাচিত কীটনাশক ব্যবহারে সতর্কতা
দেশে কীটনাশকের অবাধ ব্যবহার মাটির ক্ষতি, পানিদূষণ ও স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়াচ্ছে। এ সমস্যা সমাধানে সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা জরুরি। মাঠপর্যায়ে কৃষক প্রশিক্ষণ, জৈব কীটনাশক ও ফেরোমন ফাঁদ ব্যবহারের প্রসার উৎপাদন খরচ কমাবে এবং নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করবে।
মাটির স্বাস্থ্য রক্ষায় পদক্ষেপ
রাসায়নিকের ওপর নির্ভরশীলতার কারণে মাটির উর্বরতা কমছে। এজন্য জৈব সার, সবুজ সার ও কম্পোস্ট ব্যবহারে কৃষকদের উৎসাহিত করা প্রয়োজন। মাটি পরীক্ষা কার্ডের কার্যক্রম আরও সম্প্রসারণ করলে কৃষকেরা জমির প্রকৃতি অনুযায়ী সঠিক সার ব্যবহার করতে পারবেন। এতে উৎপাদন বাড়বে এবং জমি দীর্ঘমেয়াদে উর্বর থাকবে।
জৈব কীটনাশকের গুরুত্ব
বায়ো পেস্টিসাইড পরিবেশবান্ধব ও কম খরচে কার্যকর সমাধান। নিমের নির্যাস, অণুজীবভিত্তিক সমাধানসহ এসব উপাদান মাটির উর্বরতা বজায় রাখে এবং খাদ্যে বিষাক্ত অবশিষ্টাংশ রাখে না। সরকারের সহায়তায় এর উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ বাড়ানো গেলে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনে অগ্রগতি আসবে।
আরো পড়ুন: এনআরবিসি ব্যাংকে চাকরির সুযোগ, আবেদন করা যাবে ২১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত
ভর্তুকি নীতির সংস্কার
রাসায়নিক সার ও কীটনাশকে ভর্তুকি কৃষকের খরচ কমালেও অতিরিক্ত ব্যবহারে ক্ষতি হচ্ছে পরিবেশের। তাই ভর্তুকি ধীরে ধীরে কমিয়ে জৈব সার ও বিকল্প প্রযুক্তিতে প্রণোদনা দেওয়া উচিত। ডিজিটাল কৃষি পরামর্শ ব্যবস্থার মাধ্যমে সঠিক সময়ে সঠিক পরিমাণ সার ব্যবহার নিশ্চিত করা সম্ভব।
কৃষিতে ডিজিটাল প্রযুক্তির ভূমিকা
ড্রোন, সেন্সর, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও মোবাইল অ্যাপ এখন কৃষিতে নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টি করছে। এসব প্রযুক্তি খরচ কমিয়ে উৎপাদনশীলতা ও গুণগতমান বাড়াচ্ছে। সরকার ও বেসরকারি উদ্যোগে ছোট কৃষকদের কাছে এই প্রযুক্তি সহজলভ্য করতে হবে।
‘খামারী’ মোবাইল অ্যাপ
মাটি পরীক্ষা ও সারের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে কৃষি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে তৈরি হয়েছে ‘খামারী’ অ্যাপ। এ প্রযুক্তি কৃষকের ব্যয় কমাবে, মাটির স্বাস্থ্য রক্ষা করবে এবং পরিবেশবান্ধব কৃষি নিশ্চিত করবে।
আরো পড়ুন: এশিয়া কাপে বাংলাদেশের প্রথম পরীক্ষা আজ, প্রতিপক্ষ হংকং
কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য
মধ্যস্বত্বভোগীদের কারণে কৃষকেরা প্রাপ্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হন। কার্যকর বাজার ব্যবস্থাপনা, ডিজিটাল মার্কেটপ্লেস, প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প ও গুদামজাতকরণ উন্নয়ন করলে কৃষকের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত হবে। এতে তারা উৎসাহিত হবেন এবং গ্রামীণ অর্থনীতি হবে টেকসই।
নতুন জাত ও প্রযুক্তি সম্প্রসারণ
উচ্চফলনশীল ও জলবায়ু সহনশীল নতুন জাত কৃষিতে উৎপাদন বাড়াতে অপরিহার্য। গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো ইতোমধ্যে নতুন জাত উদ্ভাবন করেছে, যা কম পানি ও সার ব্যবহার করেও ভালো ফলন দিতে পারে। হাইড্রোপনিকস, ভার্টিক্যাল ফার্মিং ও স্মার্ট সেচ প্রযুক্তি কৃষকদের কাছে পৌঁছে দিতে হবে।
বাংলাদেশের কৃষি সংস্কার শুধু উৎপাদনশীলতা নয়, স্বাস্থ্য, পরিবেশ ও অর্থনীতির জন্য অপরিহার্য। মাটির সুরক্ষা, জৈব প্রযুক্তির প্রসার, ডিজিটাল কৃষি ও ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা গেলে কৃষক হবে স্বাবলম্বী, আর দেশ এগোবে টেকসই উন্নয়নের পথে।