এইচএসসি ফলাফল ২০২৫ নিয়ে এবার সারা দেশে চলছে বিস্ময় ও উদ্বেগ। গত ২০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ ফলাফল করেছে দেশের শিক্ষার্থীরা—যেখানে গড় পাশের হার নেমে এসেছে ৫৮ দশমিক ৮৩ শতাংশে। করোনার পর গত কয়েক বছরে যখন পাশের হার ছিল ৮০ শতাংশের ঘরে, তখন হঠাৎ এই পতনকে ‘শিক্ষাব্যবস্থার বাস্তব চিত্র’ বলছেন কেউ, আবার অনেকে দেখছেন এটিকে এক ধরনের শিক্ষা-বিপর্যয় হিসেবে।
এইচএসসি ফলাফল ২০২৫: বিপর্যয়ের চিত্র

এবারের এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নেয় ১২ লাখ ৩৫ হাজার শিক্ষার্থী, এর মধ্যে ফেল করেছে প্রায় ৫ লাখেরও বেশি। অর্থাৎ ৪১ দশমিক ১৭ শতাংশ শিক্ষার্থী অকৃতকার্য। এ সংখ্যা গত দুই দশকে সর্বোচ্চ। বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০০৫ সালের পর এবারই প্রথম গড় পাশের হার ৬০ শতাংশের নিচে নেমে গেল।
আরও অবাক করা তথ্য—গত বছরের দেড় লাখ জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর তুলনায় এবার সংখ্যা নেমে এসেছে মাত্র ৬৯ হাজার ৯৭ জনে। অর্থাৎ জিপিএ-৫ প্রাপ্তির হার প্রায় অর্ধেকে কমেছে।
বোর্ডভিত্তিক ফলাফল: কোথায় কেমন
ঢাকা বোর্ডে এবারও সর্বোচ্চ পাশের হার—৬৪ দশমিক ৬২ শতাংশ। অন্যদিকে কুমিল্লা বোর্ডে সবচেয়ে কম, মাত্র ৪৮ দশমিক ৮৬ শতাংশ। বরিশালে ৬২ দশমিক ৫৭, রাজশাহীতে ৫৯ দশমিক ৪০, দিনাজপুরে ৫৭ দশমিক ৪৯, চট্টগ্রামে ৫২ দশমিক ৫৭, সিলেটে ৫১ দশমিক ৮৬, ময়মনসিংহে ৫১ দশমিক ৫৪ এবং যশোরে ৫০ দশমিক ২০ শতাংশ শিক্ষার্থী পাস করেছে।
এছাড়া ২০২টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে একজন শিক্ষার্থীও পাস করতে পারেনি—যা দেশের শিক্ষাব্যবস্থার জন্য এক ধরনের সতর্ক সংকেত।
শিক্ষাবিদদের ব্যাখ্যা: বাস্তব মূল্যায়ন নাকি শিক্ষা সংকট?
অনেক শিক্ষক মনে করছেন, এবার এইচএসসি ফলাফল খারাপ হওয়ার মূল কারণ হলো খাতা মূল্যায়নে কঠোরতা। কুমিল্লার হোমনা ডিগ্রি কলেজের শিক্ষক তবারক উল্লাহ বলেন, “ইংরেজি ও আইসিটি বিষয়ে বেশি অকৃতকার্য হয়েছে। আবার খাতা মূল্যায়নে বাড়তি কড়াকড়ি থাকায় আগের মতো ‘সহানুভূতি নম্বর’ পাওয়া সম্ভব হয়নি।”
অন্যদিকে শিক্ষক আশিষ কুমার বিশ্বাস মনে করেন, মোবাইল ও এআই নির্ভর পড়ালেখার অভ্যাস শিক্ষার্থীদের মনোযোগ ও লেখন দক্ষতা কমিয়ে দিয়েছে। ফলে পরীক্ষার হলে তারা নিজেদের চিন্তা স্পষ্টভাবে প্রকাশ করতে পারছে না।
“সংখ্যা নয়, শেখাই হোক মূল লক্ষ্য”

অন্তর্বর্তী সরকারের শিক্ষা উপদেষ্টা ড. সি আর আবরার বলেছেন, “এবারের ফলাফল শিক্ষার্থীদের প্রকৃত যোগ্যতার প্রতিফলন। আমরা দীর্ঘদিন সংখ্যা ও শতাংশের পেছনে ছুটেছি—কিন্তু শেখার ঘাটতি ঢেকে গেছে সেই সংখ্যার আড়ালে।”
তিনি আরও বলেন, “শিক্ষার সংকট শুরু হয় প্রাথমিক স্তর থেকে। বছর বছর আমরা তা উপেক্ষা করেছি। এখন সময় এসেছে বাস্তবতাকে স্বীকার করার।”
শিক্ষায় গলদ কোথায়?
ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক খন্দোকার এহসানুল কবির বলেন, “অর্ধেক শিক্ষার্থী পাস করেনি—এটা কাঙ্ক্ষিত নয়। কিন্তু এই ফলাফল আমাদের চোখে আয়না ধরেছে। এখন সেই গলদ খুঁজে বের করতে হবে।”
আরো পড়ুন: এইচএসসির ফলে রাজধানীর সেরা কলেজগুলো: কে থাকলো শীর্ষে, কারা পিছিয়ে
শিক্ষাবিদরা বলছেন, রাজনৈতিক প্রভাব, শিক্ষক সংকট, পলিসি পরিবর্তনের অসঙ্গতি এবং মুখস্থনির্ভর শিক্ষা—সব মিলিয়ে আজকের এই ফলাফল ছিল সময়ের অপেক্ষা মাত্র।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সিদ্দিকুর রহমান খান বলেন, “এবারের ফলাফল আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার বাস্তব চিত্র তুলে ধরেছে। এতদিন আমরা রাজনৈতিকভাবে ভালো ফলাফল দেখাতে চেয়েছি—কিন্তু শেখার প্রকৃত লক্ষ্য হারিয়ে ফেলেছি।”
২০ বছরে সর্বনিম্ন এইচএসসি ফলাফল শুধু একটি পরিসংখ্যান নয়; এটি বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার ভেতরের সংকটের প্রতিফলন। শেখার চেয়ে পাশ করাই যেখানে প্রধান লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে, সেখানে প্রয়োজন একটি বাস্তবমুখী ও দক্ষতাভিত্তিক শিক্ষা সংস্কার। সংখ্যার নয়, শেখার জয় হোক—এই প্রত্যাশাই এখন সময়ের দাবি।