বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, দেশের প্রকৃত গণতন্ত্র কেবল সেই সরকারেই টিকে থাকতে পারে, যার নেতৃত্ব জনগণের ভোটে নির্বাচিত। ভারতের সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন দ্য উইক-এ প্রকাশিত এক বিশেষ প্রবন্ধে তিনি বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সমালোচনা করে বলেন, “বাংলাদেশ এখন এক অনির্বাচিত প্রশাসনের হাতে, যারা জনগণের ভোটে নয়, শক্তির জোরে ক্ষমতা দখল করেছে।”
প্রবন্ধের শুরুতে শেখ হাসিনা স্মরণ করেন তাঁর পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। তিনি লেখেন, “শৈশব থেকেই রাজনীতি আমার জীবনের অংশ ছিল। প্রতিদিন সকালে আমরা বাবার সঙ্গে বসে সংবাদপত্র পড়তাম, আলোচনা করতাম বিশ্বের ঘটনা নিয়ে।”
তিনি উল্লেখ করেন, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা অর্জনের পর বাংলাদেশের পুনর্গঠন ছিল এক বিশাল চ্যালেঞ্জ। “১৯৭২ সালে মাথাপিছু আয় ছিল ১০০ ডলারের নিচে, আর তিন বছরের মধ্যেই তা ২৫০ ডলারে পৌঁছে যায়,” বলেন তিনি।
১৯৭৫-এর অন্ধকার অধ্যায়
১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর দেশ আবার সামরিক শাসনে ফিরে যায়—যা শেখ হাসিনার ভাষায় ছিল “অগ্রগতির বিপরীত ধারা”। তিনি বলেন, “আমি আগেও অনির্বাচিত রাজনীতিকদের মুখোমুখি হয়েছি। নির্বাসন শেষে দেশে ফিরে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার লড়াই করেছি।”
‘অভিজ্ঞতাহীন প্রশাসনের হাতে দেশ’
প্রবন্ধে শেখ হাসিনা অভিযোগ করেন, বর্তমানে বাংলাদেশ “সংবিধানবিহীন ও অনভিজ্ঞ এক প্রশাসনের হাতে।” তিনি নাম না করে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সমালোচনা করে বলেন, “তিনি একজন চিন্তাবিদ, কিন্তু রাজনীতিবিদ বা রাষ্ট্রনায়ক নন। তাঁর অভিজ্ঞতার অভাব এখন দেশের সাধারণ মানুষ টের পাচ্ছে।”
তিনি দাবি করেন, ইসলামপন্থী উগ্রবাদী সংগঠনগুলো আবারও সক্রিয় হয়ে উঠেছে এবং সংখ্যালঘু, নারী ও আওয়ামী লীগ সমর্থকদের ওপর সহিংসতা বেড়েছে। মানবাধিকার সংগঠনগুলোর তথ্য উদ্ধৃত করে শেখ হাসিনা বলেন, “২০২৫ সালের প্রথম ছয় মাসে ধর্ষণের ঘটনা ৪৪১টি, যা আগের বছরের পুরো সংখ্যাকেও ছাড়িয়ে গেছে।”
অর্থনীতি ও উন্নয়ন নিয়ে আক্ষেপ
শেখ হাসিনা তাঁর শাসনামলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির কথা উল্লেখ করে বলেন, “আমাদের সময়ে জিডিপি ৪৭ বিলিয়ন ডলার থেকে প্রায় ৬০০ বিলিয়নে পৌঁছায়। আমরা দারিদ্র্য হ্রাস, নারীর কর্মসংস্থান, অবকাঠামো উন্নয়ন ও বিদ্যুৎপ্রাপ্তি নিশ্চিত করেছি।”
তবে তাঁর মতে, “বর্তমানে রাজনৈতিক অস্থিরতা, মুদ্রাস্ফীতি ও কারখানা বন্ধে শ্রমজীবী মানুষ কষ্টে আছে। আমাদের অর্জন এখন ঝুঁকির মুখে।”
আরো পড়ুন: দুই মেয়ের মধ্যে বিয়ে হলো সুন্দরবনের এক গ্রামে
বিচার ব্যবস্থা ও গণমাধ্যম নিয়ে অভিযোগ
প্রবন্ধে শেখ হাসিনা দাবি করেন, অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে বিচারব্যবস্থা “রাজনৈতিক অস্ত্রে” পরিণত হয়েছে। তাঁর ভাষায়, “ইউনূস প্রশাসন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালকে ব্যবহার করছে বিরোধী দলকে দমন করার জন্য।”
তিনি বলেন, “আওয়ামী লীগের সমর্থকদের বিরুদ্ধে হাজারো মামলা দেওয়া হয়েছে, শত শত মানুষ আটক, আর দুই শতাধিকের বেশি সমর্থক হেফাজতে মারা গেছে।”
একই সঙ্গে তিনি গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সীমিত হওয়ার অভিযোগ তোলেন—“শত শত সাংবাদিকের প্রেস কার্ড বাতিল করা হয়েছে, মিথ্যা অভিযোগে অনেককে আটক করা হয়েছে।”
গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আহ্বান
নিজের প্রবন্ধে শেখ হাসিনা লেখেন, “বাংলাদেশে প্রকৃত গণতন্ত্র ফিরে আসবে কেবল তখনই, যখন জনগণ মুক্তভাবে তাদের প্রতিনিধি নির্বাচিত করতে পারবে, ভয় বা নিষেধাজ্ঞা ছাড়া।”
তিনি বলেন, “আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করে নির্বাচন আয়োজন করলে তা গণতন্ত্রের প্রতি এক ভয়াবহ দৃষ্টান্ত হবে।”
শেখ হাসিনা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানান, তারা যেন “বাংলাদেশের চলমান বিচার প্রহসন ও রাজনৈতিক দমননীতি” সম্পর্কে সচেতন থাকে।
‘আমরা আবারও গণতন্ত্রে ফিরব’
প্রবন্ধের শেষ অংশে শেখ হাসিনা আশাবাদ প্রকাশ করে লেখেন,
“বাংলাদেশ একটি মহান দেশ, যার গর্বিত ইতিহাস আছে। আমরা অতীতেও গণহত্যা ও সামরিক শাসনের পর গণতন্ত্রে ফিরেছি। আমি প্রার্থনা করি, আমার দেশ আবারও প্রকৃত গণতন্ত্রে ফিরবে—যেখানে নারী, সংখ্যালঘু ও প্রতিটি নাগরিকের সমান অধিকার থাকবে।”

