ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচন সবসময়ই দেশের শিক্ষাঙ্গনে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। ২০২৫ সালের নির্বাচনে এবার নতুন ইতিহাস রচিত হয়েছে। ইসলামী ছাত্রশিবির সমর্থিত ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে জয়ী হয়ে ঢাবির রাজনীতিতে শক্ত অবস্থান তৈরি করেছে। মোট ২৮টি কেন্দ্রীয় পদের মধ্যে ২৩টি পদে তাদের প্রার্থীরা জয় লাভ করেছেন। এই ফলাফল ঢাবি ক্যাম্পাসের আগামী দিনের ছাত্ররাজনীতিতে বড় প্রভাব ফেলবে বলে মনে করছেন শিক্ষার্থীরা। তবে অনিয়ম ও কারচুপির অভিযোগে নির্বাচন ঘিরে বিতর্কও কম নয়।
ভিপি পদে সাদিকের জয়: সবচেয়ে আলোচিত ফলাফল
সহ-সভাপতি (ভিপি) পদকে ডাকসু নির্বাচনের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ আসন হিসেবে ধরা হয়। এবারের নির্বাচনে শিবির সমর্থিত প্রার্থী মো. আবু সাদিক কায়েম বিপুল ব্যবধানে জয়ী হয়েছেন। তিনি ১৪ হাজার ৪২ ভোট পান। নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছাত্রদল সমর্থিত আবিদুল ইসলাম খান পান মাত্র ৫ হাজার ৭০৮ ভোট। অন্যদিকে স্বতন্ত্র প্রার্থী শামীম হোসেন ৩ হাজার ৮৮৩ ভোট এবং উমামা ফাতেমা ৩ হাজার ৩৮৯ ভোট পান। এই বিপুল ব্যবধান স্পষ্ট করে দিয়েছে শিবিরের সাংগঠনিক শক্তি।
জিএস পদেও শিবিরের দাপট
সাধারণ সম্পাদক (জিএস) পদে এস এম ফরহাদ শিবির-সমর্থিত প্রার্থী হিসেবে জয়ী হয়েছেন। তিনি ১০ হাজার ৭৯৪ ভোট পান। তার প্রতিদ্বন্দ্বী তানভীর বারী হামীম ৫ হাজার ২৮৩ ভোট, প্রতিরোধ প্যানেলের মেঘমল্লার বসু ৪ হাজার ৯৪৯ ভোট এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী আরাফাত চৌধুরী ৪ হাজার ৪৪ ভোট পান। এই ফলাফল প্রমাণ করে যে ক্যাম্পাস রাজনীতিতে শিবির-সমর্থিত জোট শিক্ষার্থীদের বড় অংশের আস্থা অর্জন করেছে।
এজিএস পদে মুহিউদ্দিন খানের নিরঙ্কুশ জয়
সহসাধারণ সম্পাদক (এজিএস) পদে শিবির-সমর্থিত মুহিউদ্দিন খান ১১ হাজার ৭৭২ ভোট পেয়ে জয় লাভ করেন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছাত্রদল সমর্থিত তানভীর আল হাদী মায়েদ মাত্র ৫৬৪ ভোট পান। অন্য প্রার্থীদের প্রাপ্ত ভোটও তেমন চোখে পড়ার মতো নয়। মুহিউদ্দিন খানের এই জয় আবারও প্রমাণ করেছে যে ডাকসুর গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে শিবির-সমর্থিত প্রার্থীদের একক আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
সম্পাদকীয় পদে শিবিরের আধিপত্য
ডাকসুর বিভিন্ন সম্পাদকীয় পদেও শিবির-সমর্থিত ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোটের প্রার্থীরা জয়ী হয়েছেন। যেমন:
- মুক্তিযুদ্ধ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন সম্পাদক: ফাতেমা তাসনিম জুমা (১০,৬৩১ ভোট)
- বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্পাদক: ইকবাল হায়দার (৭,৮৩৩ ভোট)
- আন্তর্জাতিক সম্পাদক: খান জসিম (৯,৭০৬ ভোট)
- ছাত্র পরিবহন সম্পাদক: আসিফ আবদুল্লাহ (৯,০৬১ ভোট)
- ক্রীড়া সম্পাদক: আরমান হোসাইন (৭,২৫৫ ভোট)
- কমন রুম–রিডিং রুম ও ক্যাফেটেরিয়া সম্পাদক: উম্মে ছালমা (৯,৯২০ ভোট)
- মানবাধিকার ও আইন সম্পাদক: সাখাওয়াত জাকারিয়া (১১,৭৪৭ ভোট)
- স্বাস্থ্য ও পরিবেশ সম্পাদক: এম এম আল মিনহাজ (৭,০৩৮ ভোট)
- ক্যারিয়ার ডেভেলপমেন্ট সম্পাদক: মাজহারুল ইসলাম (৯,৩৪৪ ভোট)
এই তালিকা থেকে বোঝা যায়, প্রায় সব বড় সম্পাদকীয় পদে শিবির-সমর্থিত প্রার্থীরাই বিজয়ী হয়েছেন।
স্বতন্ত্র প্রার্থীদের সাফল্য
যদিও শিবির-সমর্থিত প্যানেলের প্রার্থীরা সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন দখল করেছে, তবে স্বতন্ত্র প্রার্থীরাও কিছু আসনে জয়লাভ করে আলোচনায় এসেছেন। সমাজসেবা সম্পাদক পদে যুবাইর বিন নেছারী, সাহিত্য সম্পাদক পদে মুসাদ্দিক আলী এবং গবেষণা ও প্রকাশনা সম্পাদক পদে সানজিদা আহমেদ তন্বি বিজয়ী হয়েছেন। বিশেষ করে নারী প্রার্থী সানজিদার জয় শিক্ষার্থীদের মধ্যে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
ভোটার উপস্থিতি ও নির্বাচনী পরিসংখ্যান
এবারের নির্বাচনে মোট ৪৭১ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয় ক্যাম্পাসের আটটি কেন্দ্রে ৮১০টি বুথে। মোট ভোটার ছিলেন প্রায় ৩৯,৮৭৪ জন। এর মধ্যে ছাত্রী ছিলেন ১৮,৯৫৯ জন এবং ছাত্র ছিলেন ২০,৯১৫ জন। গড় ভোটগ্রহণ হয়েছে ৭৮–৮০ শতাংশের মধ্যে। যা সাম্প্রতিক সময়ে অন্যতম উচ্চ উপস্থিতির রেকর্ড।
বিতর্ক ও অভিযোগ
ফলাফল ঘোষণার পর থেকেই নির্বাচনে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। ভিপি পদে পরাজিত আবিদুল ইসলাম খান, স্বতন্ত্র প্রার্থী উমামা ফাতেমা এবং বৈষম্যবিরোধী প্রার্থী আব্দুল কাদের ফলাফল প্রত্যাখ্যান করেছেন। তাদের অভিযোগ, ভোট গণনায় কারচুপি হয়েছে এবং নির্বাচনে স্বচ্ছতা বজায় রাখা হয়নি। এই অভিযোগগুলো ক্যাম্পাসে উত্তেজনা বাড়িয়েছে।
ঢাবি রাজনীতিতে সম্ভাব্য প্রভাব
শিবির-সমর্থিত ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোটের এই জয় ঢাবির রাজনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তনের সূচনা করবে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। ভিপি, জিএস, এজিএসসহ গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে তাদের জয় ভবিষ্যতের নীতি নির্ধারণে বড় প্রভাব ফেলবে। তবে অনিয়মের অভিযোগ প্রমাণিত হলে এই বিজয়ের বৈধতা প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে।
উপসংহার: ডাকসু নির্বাচন ২০২৫ নিঃসন্দেহে শিবিরের জন্য ঐতিহাসিক সাফল্য বয়ে এনেছে। তবে একই সঙ্গে নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় অভিযোগ-অনিয়ম বিতর্ক সৃষ্টি করেছে। এখন দেখার বিষয়, এই নির্বাচনের ফলাফল ঢাবি ক্যাম্পাসের রাজনীতিতে কীভাবে নতুন সমীকরণ তৈরি করে এবং ভবিষ্যতে শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ে কী ধরনের ভূমিকা রাখে।