শরীয়তপুরে সরকারি অ্যাম্বুলেন্সের অভাব আর বেসরকারি চক্রের নিয়ন্ত্রণে জিম্মি হয়ে পড়েছেন রোগী ও তাঁদের স্বজনেরা। জেলায় স্বাস্থ্য বিভাগের নিয়ন্ত্রণ দুর্বল হওয়ায় দীর্ঘদিন ধরে একটি প্রভাবশালী মহল অ্যাম্বুলেন্স ব্যবসায় আধিপত্য বিস্তার করেছে। সম্প্রতি এক নবজাতকের মৃত্যুর ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় আসে।
গত বৃহস্পতিবার রাতে শরীয়তপুর শহরে স্থানীয় একদল অ্যাম্বুলেন্সচালক ঢাকার একটি অ্যাম্বুলেন্স আটকে দেয়। এর জেরে সময়মতো চিকিৎসা না পেয়ে মারা যায় সদ্যোজাত এক শিশু। এ ঘটনায় এলাকাজুড়ে তোলপাড় শুরু হয়। পরে শনিবার পুলিশ প্রধান অভিযুক্ত সবুজ দেওয়ানকে গ্রেপ্তার করে।
সরকারি অ্যাম্বুলেন্স স্বল্পতায় ভোগান্তি
শরীয়তপুর জেলায় সরকারি অ্যাম্বুলেন্স রয়েছে মাত্র সাতটি। এর মধ্যে সদর হাসপাতালে দুটি থাকলেও একটি দীর্ঘদিন ধরে বিকল অবস্থায়। বাকিগুলো উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে রয়েছে, তবে ভেদরগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চালক না থাকায় সেখানকার অ্যাম্বুলেন্স অকেজো। ফলে কার্যত ছয়টি অ্যাম্বুলেন্স দিয়েই পুরো জেলার রোগী পরিবহনের কাজ চালাতে হচ্ছে।
জেলার পাঁচটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, একটি থানা স্বাস্থ্যকেন্দ্র এবং সদর হাসপাতালে প্রতিদিন শতাধিক রোগী উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় রেফার্ড হন। মাসের হিসাবে এই সংখ্যা আড়াই থেকে তিন হাজার ছাড়িয়ে যায়। অথচ সরকারি অ্যাম্বুলেন্স দিয়ে মাসে সর্বোচ্চ ৫০ থেকে ৬০ জন রোগীকে জেলার বাইরে নেওয়া সম্ভব হচ্ছে। বাকি সবাইকেই নির্ভর করতে হচ্ছে বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্সের ওপর।
সক্রিয় বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্স চক্র
তদন্তে জানা যায়, শরীয়তপুর জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের বর্তমান ও সাবেক কয়েকজন কর্মচারী মিলে একটি অ্যাম্বুলেন্স চক্র গড়ে তুলেছেন। তাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে অন্তত ২০টি অ্যাম্বুলেন্স। চক্রটি সরকারি অ্যাম্বুলেন্সের চালকদের সঙ্গে যোগসাজশ করে রোগীদের নিজেদের অ্যাম্বুলেন্সে তুলতে বাধ্য করে। বাইরের কোনো জেলা থেকে আসা অ্যাম্বুলেন্সে রোগী পরিবহন করতে দেওয়া হয় না।
গ্রেপ্তার হওয়া সবুজ দেওয়ান এই চক্রেরই সক্রিয় সদস্য। তাঁর বাবা তাহের দেওয়ান জেলা সিভিল সার্জনের গাড়ির চালক। অভিযোগ রয়েছে, তাঁর মালিকানায়ও একটি অ্যাম্বুলেন্স আছে, যদিও তিনি তা অস্বীকার করেছেন। সদর হাসপাতালের আরেক চালক জাহাঙ্গীর হোসেনেরও ব্যক্তিগত অ্যাম্বুলেন্স থাকার তথ্য পাওয়া গেছে। তিনি আরও দুটি অ্যাম্বুলেন্স দেখাশোনা করেন।
ভাড়া বেশি, সেবার মান কম
সরকারি অ্যাম্বুলেন্সে শরীয়তপুর থেকে ঢাকায় রোগী নিতে গেলে প্রতি কিলোমিটারে ২০ টাকা ভাড়া দিতে হয়। পদ্মা সেতু পারাপার ও সড়ক টোল ফ্রি থাকায় মোট খরচ দাঁড়ায় আনুমানিক চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা। কিন্তু চক্রের নিয়ন্ত্রিত বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্সে একই দূরত্বে নিতে হয় ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা।
এ ছাড়া বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্সে জরুরি চিকিৎসা সরঞ্জাম ও প্রশিক্ষিত চালকের অভাব রয়েছে। সরকারি নীতিমালা অনুযায়ী প্রতিটি অ্যাম্বুলেন্সে এসি, অক্সিজেন সিলিন্ডার ও প্রাথমিক চিকিৎসা সরঞ্জাম থাকা বাধ্যতামূলক। অথচ বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্সের অনেক চালকই রোগীকে সঠিকভাবে অক্সিজেন মাস্ক পরাতেও পারেন না। এতে ঝুঁকি বেড়ে যায় রোগীদের জীবনের।
দুঃখের কাহিনি: নবজাতকের মৃত্যু
ডামুড্যা উপজেলার মালগাঁও বাড়ৈকান্দি গ্রামের গৃহবধূ অর্চনা মণ্ডলকে (২৩) বৃহস্পতিবার রাতে শরীয়তপুর সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। অবস্থার অবনতি হলে তাঁকে ঢাকায় নেওয়ার নির্দেশ দেন চিকিৎসকেরা। কিন্তু সরকারি অ্যাম্বুলেন্স না পাওয়ায় স্বজনেরা বাধ্য হয়ে বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করেন।
অ্যাম্বুলেন্স আটকে দেওয়ার ঘটনায় সময়মতো চিকিৎসা না পেয়ে অর্চনার নবজাতক মারা যায়। এ ঘটনায় শোকাহত মা রুমা বেগম ভেঙে পড়েছেন। হাসপাতালে বারবার সন্তানের জন্য কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেন, আমার কলিজার টুকরাকে ১০ মাস শরীরের ভেতর আগলে রাখলাম। কেন সে চলে গেল? তোমরা কেন তাকে কবরে শোয়াইলা দিলে? আমি এখন কাকে নিয়ে বাঁচব?
নবজাতকের বাবা নূর হোসেন বলেন, আমরা গরিব মানুষ। মামলা করতে চাইনি। পরে সাহস জুগিয়েছেন অনেকেই। এখন অপরাধীদের দ্রুত বিচার চাই।
প্রশাসনের অবস্থান
শরীয়তপুরের সিভিল সার্জন ডা. রেহান উদ্দিন বলেন, একটি বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্স চক্র অন্য অ্যাম্বুলেন্স চলাচলে বাধা সৃষ্টি করেছে, এতে নবজাতকের মৃত্যু হয়েছে বলে অভিযোগ পেয়েছি। মামলা হয়েছে, আমরা বিষয়টি তদন্ত করব।
আরো দেখুন: শেখ হাসিনা ও কামালের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলায় আজ চতুর্থ দিনের সাক্ষ্যগ্রহণ
তিনি আরও জানান, বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্স নিয়ন্ত্রণের কোনো নীতিমালা নেই। ফলে তাদের সেবার মান ও কার্যক্রমের ওপর স্বাস্থ্য বিভাগ কোনো তদারকি চালাতে পারছে না। তবে বিকল সরকারি অ্যাম্বুলেন্স দ্রুত মেরামত ও চালক নিয়োগের বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে জানানো হয়েছে।
সমাধান কোথায়?
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, শরীয়তপুরের ঘটনাটি গোটা দেশের অ্যাম্বুলেন্স সেবার সংকটের প্রতিচ্ছবি। নীতিমালার অভাব, সরকারি অ্যাম্বুলেন্সের স্বল্পতা এবং দায়িত্বে থাকা কিছু কর্মচারীর অনিয়ম পুরো ব্যবস্থাকে অচল করে তুলেছে। এর ফলে প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ জিম্মি হচ্ছেন চক্রের কাছে, ঝুঁকিতে পড়ছে জীবন।
আরো দেখুন: পুতিনের পাঁচ দাবি নিয়ে ট্রাম্প-জ়েলেনস্কি দর কষাকষি: কোনটি কতটা বাস্তবসম্মত?
স্থানীয়দের দাবি, অবিলম্বে বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্স নিয়ন্ত্রণে আনা, সরকারি অ্যাম্বুলেন্স সংখ্যা বৃদ্ধি এবং দুর্নীতিতে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। নইলে এ ধরনের মৃত্যুর মিছিল থামবে না।