রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন ক্ষমতা ২ হাজার মেগাওয়াট থেকে ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াটে বাড়ানো হলেও এ-সংক্রান্ত অনুমোদনের কোনো কাগজপত্র খুঁজে পাওয়া যায়নি। মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় (সিএজি) তাদের সর্বশেষ প্রতিবেদনে এ তথ্য প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রকল্পটির ব্যয় ব্যবস্থাপনা ও অবকাঠামো চুক্তির প্রক্রিয়ায় গুরুতর অনিয়ম ও অস্বচ্ছতার প্রমাণ মিলে।
ব্যয় দ্বিগুণ হলেও নেই সঠিক ব্যাখ্যা
২০১১ সালে বাংলাদেশ ও রাশিয়ার মধ্যে প্রথম চুক্তি অনুযায়ী, প্রতিটি এক হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতার দুটি ইউনিট নির্মাণের কথা ছিল। তবে ২০১৫ সালে চূড়ান্ত চুক্তিতে প্রতিটি ইউনিটের ক্ষমতা বাড়িয়ে এক হাজার ২০০ মেগাওয়াট করা হয়। এর ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা বেড়ে দাঁড়ায় ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াটে। কিন্তু সিএজির নিরীক্ষকরা এ পরিবর্তনের অনুমোদন বা খরচ বৃদ্ধির যৌক্তিক কোনো নথি পাননি।
উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ানোর ফলে প্রকল্প ব্যয় প্রায় দ্বিগুণ হয়ে দাঁড়ায় সোয়া লাখ কোটি টাকা, যা ১৩ দশমিক ১৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। অথচ এ সিদ্ধান্তের পেছনে থাকা আলোচনার কাগজপত্রও খুঁজে পাননি নিরীক্ষকরা।
চুক্তি ও আলোচনায় স্বচ্ছতার ঘাটতি
সিএজির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০১২ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমানের নেতৃত্বে খরচ নির্ধারণে একটি সরকারি সমঝোতা দল গঠন করা হয়। তবে এ দলের আলোচনার কোনো প্রমাণ নেই। বরং ২০১৫ সালের ডিসেম্বরেই সরাসরি রাশিয়ার অ্যাটমস্ট্রয় এক্সপোর্টের সঙ্গে ১২ দশমিক ৬৫ বিলিয়ন ডলারের চুক্তি সই হয়। এর আগে ২০১৩-১৫ সালের মধ্যে আরও চারটি প্রস্তুতিমূলক চুক্তি হয়, যেগুলোর মূল্য ছিল প্রায় ০.৫৪৫৯ বিলিয়ন ডলার।
হোটেল ভাড়া ও নগদ উত্তোলনে অনিয়ম
প্রতিবেদনে বলা হয়, রাশিয়ার বিভিন্ন শহরে যন্ত্রপাতি পরীক্ষার জন্য কোয়ালিটি ইন্সপেকশন ইউনিট ভাড়া নেওয়া হলেও একই সময়ে হোটেল খরচ দেখিয়ে অতিরিক্ত দুই কোটি ৭৯ লাখ টাকার বেশি ব্যয় দেখানো হয়েছে। এ ছাড়া উপপ্রকল্প পরিচালক ড. মো. জাহেদুল হাছান ২০১৮ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে রাশিয়ায় আবাসন ভাড়ার নামে প্রায় ৭৭ লাখ টাকা নগদ তুলেছেন, যার যথাযথ হিসাব মেলেনি।
আরো পড়ুন: ইলন মাস্কের সমালোচনায় মাইক্রোসফট কর্মীরা, নাদেলার কাছে জবাব চাইলেন মাস্ক
বিশেষজ্ঞ ও টিআইবির মন্তব্য
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউক্লিয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, “পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র একটি দেশের মর্যাদার প্রতীক হলেও এ প্রকল্প বাস্তবায়নে অস্বচ্ছতা দেখা যাচ্ছে। অভিযোগগুলো গুরুত্বসহকারে তদন্ত করা জরুরি।”
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “রূপপুর প্রকল্প শুরু থেকেই বিতর্কিত। প্রতিযোগিতা ছাড়াই রাশিয়ার হাতে এত বড় প্রকল্প দেওয়া হয়েছে। নির্মাতা প্রতিষ্ঠান রোসাটমের বিরুদ্ধেও দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। শুধু রাজনৈতিক নেতৃত্ব নয়, সংশ্লিষ্ট আমলাদেরও দায়ী করতে হবে।”
আন্তর্জাতিক তুলনায় বেশি খরচ
আইএইএর তথ্য অনুযায়ী, রাশিয়ায় ভিভিআর-১২০০ প্রযুক্তির বিদ্যুৎকেন্দ্রে প্রতি কিলোওয়াট নির্মাণ খরচ হয় প্রায় ৪ হাজার ৭৫ ডলার। অথচ রূপপুরে সেই খরচ দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ৮৯০ ডলার। তুলনায় ফিনল্যান্ডে খরচ ছিল ৫ হাজার ডলার এবং তুরস্কের আক্কুইউ প্রকল্পে মাত্র ৩ হাজার ২০০ ডলার।
এখন পর্যন্ত রূপপুর প্রকল্পের ৯৫ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। এ বছর বিদ্যুৎ উৎপাদনে যাওয়ার কথা থাকলেও তা পিছিয়ে গেছে এক বছর।