
রাজধানীর উত্তরার দিয়াবাড়ীর মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ক্যাম্পাসে বিমান বাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হয়ে ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটেছে। এর ফলে ১৯জন নিহত হয়েছেন এবং শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন বলে জানা গেছে। এই দুর্ঘটনার কারণে সরকার ২২ জুলাই মঙ্গলবার এক দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করেছে। সারা দেশে সরকারি ও বেসরকারি ভবনে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয়েছে। দেশের প্রতিটি ধর্মীয় উপাসনালয়ে আহত ও নিহতদের জন্য বিশেষ প্রার্থনা অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
এই ঘটনায় রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপ থাকলেও, এখনো কোনো নির্দিষ্ট অনুসন্ধান কমিটির কথা জানানো হয়নি যা থাকলে মানুষের মধ্যে স্বচ্ছতা ও আস্থার বার্তা দিত।
এই দুর্ঘটনা এমন এক জায়গায় ঘটেছে, যা শিক্ষার্থীদের জন্য সংরক্ষিত একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। নিরাপদ পরিবেশে পড়াশোনা করার কথা যাদের, তাদের একদল শিক্ষার্থী এখন হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে দগ্ধ অবস্থায় কষ্ট পাচ্ছে। ইতিমধ্যে ৭০ জনকে জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়েছে।
প্রশ্ন উঠছে, কেন একটি যুদ্ধবিমান এমন জনবহুল ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এলাকায় ওড়ানো হলো?
এই তথ্যের মধ্যে বিমান বাহিনীর ভুল বা ত্রুটি নিয়ে কোনো তদন্তের তথ্য নেই, যা থাকলে দায় নির্ধারণে সহায়ক হতো। পাশাপাশি, এয়ারফোর্সের এফ-৭ বিজিআই বিমানের বয়স, রক্ষণাবেক্ষণ ইত্যাদি বিষয়েও কিছু জানা যায়নি।
বিমানটি দুপুর ১টা ৬ মিনিটে উড্ডয়ন করে এবং মাত্র ১২ মিনিট পর ১টা ১৮ মিনিটে বিধ্বস্ত হয়। এতে বোঝা যাচ্ছে বিমানটি আকাশে থাকার পর্যাপ্ত সময়ই পায়নি। প্রশ্ন হচ্ছে, এফ-৭ বিজিআই (৭০১) নামের এই বিমানে কোনো প্রযুক্তিগত ত্রুটি ছিল কিনা, নাকি এটি মানবিক ভুলের ফল?
এই বিষয়ে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের পক্ষ থেকে শুধু ঘটনাটি ঘটেছে এইটুকুই বলা হয়েছে, তবে তদন্ত কমিটি, সম্ভাব্য কারণ, অথবা ভবিষ্যৎ প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিয়ে কিছুই জানানো হয়নি। এই ধরনের গোপনীয়তা জনমনে সন্দেহ ও আতঙ্ক বাড়ায়।
যদিও ১৯ জন নিহত হয়েছেন বলা হয়েছে, তবু তাদের নাম, বয়স, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, পারিবারিক পটভূমি এসব কিছু এখনো সরকারিভাবে প্রকাশ হয়নি। আহতদের মধ্যেও শতাধিক শিক্ষার্থী রয়েছেন, কিন্তু তাদের কারা কারা কোন অবস্থা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি তা জানা যায়নি। যদি একটি হেল্পলাইন, তথ্যকেন্দ্র বা দ্রুত পরিচয় প্রকাশের উদ্যোগ থাকত, তাহলে সামাজিক বিশৃঙ্খলা ও গুজব অনেকটাই রোধ করা যেত।
সরকারের একদিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা একটি প্রশংসনীয় পদক্ষেপ হলেও, এ ধরনের দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর আর্থিক ও মানসিক পুনর্বাসন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এখনো পর্যন্ত ক্ষতিপূরণ ঘোষণা, পরিবারভিত্তিক সহায়তা বা ছাত্রদের পুনর্বাসন পরিকল্পনার বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত জানানো হয়নি।
এই অনুপস্থিত বিষয়গুলোর কারণে মনে হচ্ছে, সরকার শুধুমাত্র আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করছে, কিন্তু বাস্তব সহায়তা ও দৃষ্টিভঙ্গি এখনো অপ্রকাশিত।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এই দুর্ঘটনায় শোক জানিয়ে একটি মানবিক বার্তা দিয়েছেন। তিনি দলের সব স্তরের নেতাকর্মীদের, বিশেষ করে যুবদল, ছাত্রদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলকে ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন। এটি রাজনৈতিক না হয়ে একটি মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির বার্তা হিসেবে দেখা যাচ্ছে, যা সমালোচনা নয়, বরং ঐক্যের আহ্বান।
তবে, সরকারি দলের পক্ষ থেকেও যদি একই রকম বার্তা ও সহায়তার ঘোষণা আসত, তাহলে এটি জাতীয় ঐক্যের বার্তা দিত এবং দেশের রাজনৈতিক পরিবেশে ইতিবাচকতা আনার সুযোগ সৃষ্টি হতো।
এই দুর্ঘটনা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে যে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আশপাশে বিপজ্জনক অনুশীলন নয়, বরং নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই প্রথম দায়িত্ব। এছাড়া, প্রতিটি ফ্লাইটের রুট ও নিরাপত্তা পরিকল্পনায় জনগণের নিরাপত্তাকে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত। ঘটনার পরপরই একটি তদন্ত কমিটি, হেল্পলাইন, তথ্যকেন্দ্র ও মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা ইউনিট স্থাপন করা হলে, তা শুধু সরকারের দক্ষতা নয়, জনগণের আস্থা অর্জনের মাধ্যমও হতো।
এই মুহূর্তে কেবল একটি দিনের শোক যথেষ্ট নয়। আহতদের চিকিৎসা, নিহতদের পরিবারের সহায়তা, ভবিষ্যতের নিরাপত্তা ব্যবস্থা সব মিলিয়ে একটি দায়িত্বশীল রোডম্যাপ দরকার। মানুষ চায়, এমন দুর্ঘটনা যেন আর না ঘটে আর সেটা সম্ভব পরিকল্পনা, স্বচ্ছতা, ও আন্তরিকতা থাকলে।