দেশের মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষার মান নিয়ে উদ্বেগ আরও গভীর হচ্ছে। ইংরেজি ও গণিতে দুর্বল শিক্ষার্থীর হার দ্রুত বাড়ছে, যা শিক্ষা বিশেষজ্ঞদের কাছে বড় সতর্ক সংকেত হিসেবে ধরা হচ্ছে। নতুন এক গবেষণায় দেখা গেছে, শিক্ষার্থীরা প্রত্যাশিত দক্ষতা অর্জন করতে পারছে না ফলে উচ্চশিক্ষা ও কর্মজীবনে পিছিয়ে পড়ছে তারা।
গবেষণার চিত্র: গণিতে ভয়াবহ পতন
মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) “মাধ্যমিক শিক্ষার্থীদের জাতীয় মূল্যায়ন–২০২৩” প্রতিবেদনে উঠে এসেছে উদ্বেগজনক তথ্য।
- ২০১৯ সালে অষ্টম শ্রেণিতে গণিতে দুর্বল শিক্ষার্থীর হার ছিল ২২%,
- ২০২৩ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৭% অর্থাৎ প্রায় দ্বিগুণ।
দশম শ্রেণিতেও গণিতে দুর্বল শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়েছে। ইংরেজিতেও একই চিত্র অষ্টম শ্রেণিতে দুর্বল শিক্ষার্থীর হার উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।
মূল্যায়নের পরিসর ও বাস্তবতা
এই গবেষণাটি দেশের ৯৯৯টি বিদ্যালয় ও মাদ্রাসার ৬০ হাজার শিক্ষার্থী (অষ্টম ও দশম শ্রেণি মিলিয়ে) নিয়ে পরিচালিত হয়। পরীক্ষাগুলো নেওয়া হয়েছিল গত বছরের ১২ জুলাই সারা দেশে একযোগে। ফলাফল বলছে
শিক্ষার্থীদের বড় অংশ শিক্ষাক্রম অনুযায়ী দক্ষতা অর্জন করতে পারছে না। ইংরেজি ভাষায় সাধারণ কথোপকথন বা বাক্যগঠনেও অনেক শিক্ষার্থী হিমশিম খায়, আর গণিতে মৌলিক হিসাব করতেও সমস্যা হয়।
দক্ষতা অর্জনে শহর–গ্রাম বৈষম্য
গবেষণায় দেখা গেছে, শহরের শিক্ষার্থীরা গ্রামীণ শিক্ষার্থীদের তুলনায় অনেক বেশি দক্ষ।
- মেয়েরা ছেলেদের তুলনায় সামান্য এগিয়ে,
- সাধারণ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের তুলনায় ভালো ফল করেছে।
তবে সার্বিক চিত্রে দেখা যায়, অধিকাংশ শিক্ষার্থীই ইংরেজি ও গণিতে কাঙ্ক্ষিত মানে পৌঁছাতে পারেনি।
শিক্ষাবিদদের বিশ্লেষণ
শিক্ষাবিদদের মতে, এর পেছনে একাধিক কারণ কাজ করছে
- কোভিড–১৯ মহামারিজনিত দীর্ঘ শিক্ষাবিরতি,
- নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে জটিলতা ও শিক্ষক প্রশিক্ষণের ঘাটতি,
- কোচিং–নির্ভর শিক্ষাব্যবস্থা ও শ্রেণিকক্ষে মনোযোগের অভাব।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক এস এম হাফিজুর রহমান বলেন,
“শিক্ষকদের বড় অংশ এখনও নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী শেখাতে সক্ষম নয়। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ ও মূল্যায়নব্যবস্থা আরও জোরদার করতে হবে।”
মাউশির অবস্থান ও করণীয়
মাউশির মহাপরিচালক অধ্যাপক মুহাম্মদ আজাদ খান বলেন,
“গবেষণার ফলাফল বাস্তব। মানোন্নয়নে প্রকল্প চালু রয়েছে এবং প্রতিটি বিষয়ে ভালো ‘কনটেন্ট’ তৈরি করে তা সব বিদ্যালয়ে পৌঁছে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এতে সমস্যা অনেকাংশে কেটে যাবে বলে আশা করছি।”
তিনি আরও জানান, দুর্বল শিক্ষার্থীদের আলাদা যত্ন নেওয়ার ব্যবস্থা জোরদার করা হবে, যাতে অকৃতকার্য ও ঝরে পড়ার হার কমে আসে।
আরো পড়ুন:ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি’ কাঠামোয় বৈষম্য বাড়বে: শিক্ষা ক্যাডারের আশঙ্কা
এসএসসি ফলাফলেও প্রতিফলন
২০২৫ সালের এসএসসি পরীক্ষার ফলেও এই দুর্বলতার প্রতিফলন স্পষ্ট। গণিতে পাসের হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে, যা সামগ্রিক ফলাফলকেও প্রভাবিত করেছে। শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করেছে, “প্রশ্ন কঠিন ছিল”, তবে শিক্ষা বিশেষজ্ঞদের মতে, মূল কারণ হলো মৌলিক ধারণার ঘাটতি।
দক্ষতা বৃদ্ধির পথ
বিশেষজ্ঞরা বলছেন
- প্রতিটি স্কুলে দুর্বল শিক্ষার্থীদের জন্য রেমিডিয়াল ক্লাস চালু করা,
- শিক্ষকদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ ও মনিটরিং,
- শহর–গ্রাম শিক্ষার ডিজিটাল কনটেন্টে সমান প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা
এসবই হতে পারে ভবিষ্যতের মূল সমাধান।