স্প্যানিশ লা লিগায় প্রতিযোগিতা যখন জমে উঠেছে ঠিক তখনই ধারাবাহিক বিপর্যয়ে পড়ে গেছে রিয়াল মাদ্রিদ। টানা তৃতীয় ম্যাচে পয়েন্ট খোয়ানোর পর লিগ টেবিলের শীর্ষস্থানটি হাতছাড়া হয়ে গেছে তাঁদের। সুযোগটি অসাধারণভাবে কাজে লাগিয়েছে প্রতিদ্বন্দ্বী বার্সেলোনা, যারা নিজেদের ধারাবাহিক জয় ধরে রেখে এখন দৃঢ়ভাবে অবস্থান করছে লিগের এক নম্বর স্থানে। ফুটবলবিশ্বে তাই এখন আলোচনার কেন্দ্র কি হচ্ছে রিয়ালের? আর কিভাবে শীর্ষে ফিরল বার্সা
রিয়ালের ধস কোথায় হচ্ছে সমস্যা
রিয়ালের মৌসুমটি শুরু হয়েছিল দারুণ ছন্দে। মিডফিল্ডে বেলিংহ্যাম, ভিনিসিউসের ফ্লেয়ার, রদ্রিগোর গতি সব মিলিয়ে দলের আক্রমণভাগ ছিল ভয়ঙ্কর। কিন্তু গত তিন ম্যাচ তাদের চেনার উপায় নেই।
প্রথম ম্যাচে প্রতিপক্ষের রক্ষণভেদের অভাবে হারায় দুই পয়েন্ট। দ্বিতীয় ম্যাচে গোল পেলেও রক্ষণভাগের দুর্বলতায় হারায় জয়। আর তৃতীয় ম্যাচে দেখা গেল সম্পূর্ণ ছন্দহীন রিয়ালকে যেখানে মাঝমাঠে সৃজনশীলতা নেই, আক্রমণেও নেই ধার।
বিশেষজ্ঞদের মতে, সবচেয়ে বড় সংকট দেখা যাচ্ছে রক্ষণভাগে। মিলিটাও আলাবা যুগলীর ইনজুরি দলের কাঙ্ক্ষিত স্থিতিশীলতা কেড়ে নিয়েছে। নাচো–রুডিগার জুটি অভিজ্ঞ হলেও সাম্প্রতিক ম্যাচগুলোতে তারা বারবার ভুল করেছে, যার মাশুল দিতে হয়েছে পয়েন্ট খুইয়ে।
এ ছাড়া আক্রমণভাগেও সমস্যা স্পষ্ট। বেনজেমার বিদায়ের পর এখনো পর্যন্ত একজন ক্লিনিক্যাল ফিনিশারের ঘাটতি স্পষ্ট হচ্ছে। বেলিংহ্যাম গোল করলেও এটা দীর্ঘমেয়াদে সমাধান নয়। ভিনিসিউস ইনজুরিতে পড়ে ছন্দ হারিয়েছেন। রদ্রিগো গত মৌসুমের ধারাবাহিকতা দেখাতে পারছেন না।
মাঝমাঠেও সংকট
মড্রিচ ও ক্রুস বয়সের ভারে আগের মতো ধার দিতে না পারায় তাদের ব্যবহার কমেছে। কামাভিঙ্গা ও টচুয়ামেনি সম্ভাবনাময় হলেও মাঝে মাঝে সিদ্ধান্তহীনতায় পড়ছেন। ফলে আক্রমণের সাপোর্ট কমে যাচ্ছে, আর সেই সুযোগে প্রতিপক্ষ সহজেই চাপ সৃষ্টি করছে।
রিয়াল সমর্থকদের হতাশা
মাদ্রিদিস্তাদের মধ্যে এখন উদ্বেগ বাড়ছে। তিন ম্যাচে ছয় পয়েন্ট হারানো কোনো ছোট বিষয় নয় বিশেষত তখন, যখন বার্সা প্রতিটি ম্যাচে উচ্চমানের ফুটবল খেলছে। অনেকে কোচ আনচেলত্তির প্রেসিং বা রোটেশন পদ্ধতি নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন। বিশেষ করে বড় খেলোয়াড়দের বিশ্রাম, ইনজুরি ম্যানেজমেন্ট এবং মাঠের পরিকল্পনায় দুর্বলতা নিয়ে আলোচনা চলছে প্রবলভাবে।
বার্সার উত্থান কীভাবে শীর্ষে ফিরল তারা
যতটা হতাশ রিয়াল–সমর্থকরা, ঠিক তার উল্টো চিত্র এখন বার্সা শিবিরে। তাদের ফর্মটা যেন ধীরে ধীরে সেরা জায়গায় উঠে এসেছে। দলে নেই মেসি–নেইমার যুগের তারকাদের সেই জৌলুস, কিন্তু দলগত সমন্বয়ই এখন তাদের সবচেয়ে বড় শক্তি।
আরো পড়ুন : ৭ গোলে জিতলেন ক্রিকেটার জাভেদ ওমর-মাঠে ফুটবলের অন্য রূপ
১. তারুণ্য + অভিজ্ঞতার দুর্দান্ত মিশ্রণ
গ্যাভি ও পেদ্রির নেতৃত্বে তরুণরা মাঠে দিচ্ছে সর্বোচ্চ পরিশ্রম। এর সঙ্গে লেভানদোভস্কির অভিজ্ঞতা, জোয়াও ফেলিক্সের সৃজনশীলতা এবং কুন্দে–আরাউহোর রক্ষণভাগে দৃঢ় উপস্থিতি দলকে এগিয়ে নিচ্ছে।
এই বার্সা তারুণ্যের ঝলক আর দ্রুতগতির পাসিং–ফুটবল দিয়ে প্রতিপক্ষকে চাপে রাখছে নিয়মিত।
২. কোচের পরিকল্পনার সাফল্য
কোচ জাভি হার্নান্দেজ দলে যে পরিবর্তন এনেছেন তা এখন স্পষ্টভাবে ফল দিচ্ছে। উচ্চ প্রেসিং, বল দখলে আধিপত্য (পজিশন ফুটবল), এবং প্রতি আক্রমণে দ্রুততা সবই মিলছে গত কয়েক ম্যাচে।
সদ্য শেষ ম্যাচে বার্সা যেভাবে তিন পয়েন্ট তুলে নিয়েছে, তা শুধু কৌশলগত পরিপূর্ণতার প্রমাণ নয়, বরং তাদের আত্মবিশ্বাস এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি।
৩. ইনজুরির ঝামেলা কাটিয়ে ফেরা
মৌসুমের শুরুতে ইনজুরিতে ভুগেছিল বার্সা। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়দের ফিরে আসায় এখন দলটা অনেক বেশি ভারসাম্যপূর্ণ। রাফিনিয়া ফাতি ইয়ামালের গতির সঙ্গে মিডফিল্ডের কন্ট্রোল একসঙ্গে কাজ করছে।
লিগ টেবিলের চিত্র
তিন ম্যাচে রিয়ালের পয়েন্ট হারানোর পর লিগ টেবিলে বড় পরিবর্তন এসেছে। যেখানে রিয়াল কয়েক সপ্তাহ আগেও শীর্ষে ছিল, এখন তারা পিছিয়ে গেছে বার্সার কাছে।
বার্সা ধারাবাহিক জয়ে এখন লিগ টেবিলের প্রথম স্থানে, আর রিয়াল নেমে গেছে দ্বিতীয় বা তৃতীয় স্থানে ম্যাচের ফল অনুযায়ী।
এই অবস্থান রিয়াল–সমর্থকদের কাছে অস্বস্তিকর হলেও বার্সা–সমর্থকদের কাছে এটি যে উৎসবের আনন্দ তা বলাই বাহুল্য।
আগামী দিনগুলোতে কী হতে পারে
লা লিগার মৌসুম এখনো অনেক বাকি। দু’দলই যদি পুরো মৌসুমের দিকে তাকায়, তবে খুব স্পষ্টভাবে বলা কঠিন শেষ পর্যন্ত কে শিরোপা জিতবে। রিয়াল যদি দ্রুত ছন্দে ফিরতে পারে, তাহলে তারা আবারও শীর্ষে উঠে আসার সামর্থ্য রাখে। বিশেষত বড় ম্যাচগুলোতে তাদের অভিজ্ঞতা সব সময়ই বাড়তি সুবিধা দেয়।
তবে বার্সাও এখন এমন অবস্থায় নেই যে সহজে পয়েন্ট হারাবে। তাদের খেলোয়াড়দের গতি, দলের গভীরতা ও মানসিক দৃঢ়তা এখন শিরোপার দৌড়ে বড় ভূমিকা রাখবে।
রিয়ালের করণীয়
রিয়ালকে দ্রুত কিছু ব্যবস্থা নিতে হবে
রক্ষণভাগে স্থিতিশীলতা আনতে হবে।মাঝমাঠে সৃজনশীলতা বাড়াতে হবে।আক্রমণ ভাগে ধারাবাহিক গোলস্কোরারের প্রয়োজন।ইনজুরি ম্যানেজমেন্ট আরও উন্নত করতে হবে।দলগত সমন্বয় আরও বাড়াতে হবে।
এ ছাড়া কোচ আনচেলত্তিকে কিছু পরীক্ষামূলক সিদ্ধান্ত নিতে হতে পারে বিশেষত আক্রমণের নতুন ধরণ বা বিকল্প কৌশল প্রয়োগে।
বার্সার লক্ষ্য
বার্সার কাজ একটাই
ধারাবাহিকতা ধরে রাখা।
গত তিন সপ্তাহে তারা যা দেখিয়েছে, তা যদি আরও দু’মাস অব্যাহত রাখতে পারে, তবে লিগের শীর্ষস্থান ধরে রাখা তাদের জন্য কঠিন হবে না।
সমর্থকদের প্রতিক্রিয়া
ফুটবল–সমর্থকদের উত্তেজনা এখন তুঙ্গে। সামাজিক মাধ্যমে বার্সা–সমর্থকরা শীর্ষে ওঠার উচ্ছ্বাস প্রকাশ করছে, অন্যদিকে রিয়াল ফ্যানরা দল নিয়ে উদ্বেগ জানাচ্ছেন। এল ক্লাসিকো সামনে থাকলে তো উত্তেজনা আরও বেড়ে যাবে এখনই আলোচনা শুরু হয়ে গেছে, কারা যাবে সেই ম্যাচে আধিপত্য দেখিয়ে?
লা লিগার এই মৌসুম এখন পর্যন্ত নাটকীয়তায় ভরপুর। রিয়ালের টানা তিন ম্যাচে পয়েন্ট হারানো কেবল লিগের চিত্রই বদলে দেয়নি, বরং শীর্ষস্থানে নতুন উত্তেজনা তৈরি করেছে। বার্সেলোনা এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে নিজেদের ছন্দে রেখেছে এবং এখন টেবিলের শীর্ষে দৃঢ়ভাবে অবস্থান করছে।
আগামীদিনে দু’দলের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা আরও তীব্র হবে এটাই লা লিগাকে বিশ্ব ফুটবলের একটি অনন্য উত্তেজনাপূর্ণ টুর্নামেন্টে পরিণত করে।

