মেলবোর্ন, ২৭ অক্টোবর: বাংলাদেশের সাবেক ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের পক্ষে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (ICC) প্রসিকিউটরের কাছে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগে একটি আনুষ্ঠানিক আবেদন দাখিল করা হয়েছে। লন্ডনভিত্তিক মানবাধিকার আইন সংস্থা Doughty Street Chambers এই আবেদনটি (Article 15 Communication) জমা দেয়, যেখানে সাম্প্রতিক রাজনৈতিক সহিংসতাকে ‘Crimes Against Humanity’ হিসেবে চিহ্নিত করে তদন্ত শুরুর আহ্বান জানানো হয়েছে।
রাজনৈতিক সহিংসতার অভিযোগে তদন্ত চাওয়া

ব্রিটিশ ব্যারিস্টার স্টিভেন পাওলস কেসি (Steven Powles KC) এই আবেদনটি আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে দাখিল করেন। আবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৪ সালের জুলাই থেকে বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ সংশ্লিষ্ট বা সমর্থকদের ওপর সংগঠিত সহিংসতা ও প্রতিশোধমূলক হামলা হত্যা, অবৈধ আটক ও নির্যাতনের মতো মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধে পরিণত হয়েছে।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে—
- অন্তত ৪০০ জন আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী নিহত হয়েছেন, যাদের অনেককে জনতার হাতে লিঞ্চিং বা প্রহারে হত্যা করা হয়েছে।
- ২৫ জন বন্দী কারাগারে মারা গেছেন, যাদের দেহে “নির্যাতনের স্পষ্ট চিহ্ন” দেখা গেছে।
- অপারেশন ‘ডেভিল হান্ট’ নামের অভিযানে মাত্র ১২ দিনে প্রায় ১৮ হাজার মানুষকে গ্রেফতার করা হয়।
- ২০২৪ সালের ১৪ অক্টোবর অন্তর্বর্তী সরকার একতরফা ইমিউনিটি অর্ডার জারি করে, যাতে জুলাই–আগস্টের ঘটনাগুলোতে জড়িতদের বিচার থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
আবেদনে বলা হয়, এসব অপরাধের সুষ্ঠু তদন্ত বা বিচার বাংলাদেশে সম্ভব নয়, ফলে আন্তর্জাতিক আদালতের হস্তক্ষেপ প্রয়োজন।
মানবাধিকার আইন সংস্থা Doughty Street Chambers
লন্ডনভিত্তিক এই সংস্থাটি ১৯৯০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার, যুদ্ধাপরাধ ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষার মামলায় বৈশ্বিকভাবে পরিচিত। সংস্থাটির মধ্যে আছেন প্রখ্যাত আইনজীবী এডওয়ার্ড ফিটজগেরাল্ড KC, স্টিভেন পাওলস KC, এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনজীবী আমাল ক্লুনি (সাবেক সদস্য)।
অন্তর্বর্তী সরকারের পদক্ষেপ ও আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে অন্তর্বর্তী প্রশাসন “অপারেশন ডেভিল হান্ট” চালু করে, যার লক্ষ্য হিসেবে “আওয়ামী ফ্যাসিবাদ দমন” ঘোষণা করা হয়। পুলিশ ও সেনাবাহিনীর যৌথ এই অভিযানে ব্যাপক গ্রেফতার এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ ওঠে। এদিকে, ২০২৪ সালের অক্টোবরে ঘোষিত ইমিউনিটি অর্ডারের মাধ্যমে ছাত্র ও নাগরিকদের বিচার থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়, যা আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞদের মতে “রাষ্ট্রীয় পক্ষপাত ও দায়মুক্তির” ইঙ্গিত বহন করে।
আরো পড়ুন: বঙ্গোপসাগরে ঘূর্ণিঝড় ‘মোন্থা’ আরও শক্তিশালী, ৪ বন্দরকে দুই নম্বর হুঁশিয়ারি সংকেত
আইসিসি তদন্ত শুরু হলে পরিণতি কী হতে পারে
বাংলাদেশ ২০১০ সালে রোম স্ট্যাটিউট অনুমোদন করায় দেশটি ইতিমধ্যেই আইসিসির বিচারিক আওতায় রয়েছে। যদি আদালত তদন্ত শুরু করে এবং দায়ী ব্যক্তিদের মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধে অভিযুক্ত করে, তাহলে আন্তর্জাতিক গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হতে পারে। অভিযুক্তরা ইউরোপ, যুক্তরাজ্য, কানাডা বা অন্য যে কোনো রোম স্ট্যাটিউট স্বাক্ষরকারী দেশে প্রবেশ করলে গ্রেফতার হতে পারেন।
দোষ প্রমাণিত হলে আজীবন কারাদণ্ড, সম্পত্তি জব্দ ও আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা যেতে পারে। তবে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত মৃত্যুদণ্ড প্রদান করে না।
বাংলাদেশের জন্য সম্ভাব্য ঐতিহাসিক প্রক্রিয়া
এটি যদি আনুষ্ঠানিকভাবে গৃহীত হয়, তবে বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো কোনো সরকার বা রাজনৈতিক প্রশাসনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধে তদন্ত শুরু হবে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এ ধরনের তদন্ত রাজনৈতিক প্রতিশোধের পরিবর্তে আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার একটি নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারে।

