Friday, December 19, 2025
Homeবোলারদের দাপটের দিনে জিল্লুরের প্রথম সেঞ্চুরি

বোলারদের দাপটের দিনে জিল্লুরের প্রথম সেঞ্চুরি

ক্রিকেটে এমন কিছু দিন থাকে যা নিজস্ব গল্প লেখে দিনটি বদলায়, চরিত্র বদলায়, কিন্তু স্মৃতি থেকে যায় চিরস্থায়ী। আজকের ম্যাচটি ঠিক তেমনই একটি দিন, যেখানে ব্যাটসম্যানদের জন্য ছিল কেবল বেঁচে থাকার লড়াই মাঠে ছিল ঘূর্ণায়মান সন্দেহ একদিকে পেসারদের আগুনে গতি, অন্যদিকে স্পিনারদের চতুর ফাঁদ। বল বাঁক নেয় কখনো হঠাৎ, কখনো সুইং হয়ে ফিরে আসে ব্যাটের ধার ঘেঁষে। সেই কঠিন দিনে ক্রিকেট বিশ্ব নতুন এক নায়ককে চেনে জিল্লুর রহমান।

বোলারদের দুর্দান্ত প্রদর্শনের মাঝেও তাঁর ব্যাট ছিল স্থির চোখে ছিল আগুন, আর মনোযোগ ছিল পাহাড়ের মতো শক্ত। আর সেই মনোযোগই তাঁকে এনে দিয়েছে ক্যারিয়ারের প্রথম আন্তর্জাতিক সেঞ্চুরি যা শুধু একটি ইনিংস নয় বরং এক সংগ্রামের ইতিহাস অধ্যবসায়ের উদাহরণ এবং ভবিষ্যতের প্রতিশ্রুতির অগ্নিশপথ।

ম্যাচের প্রেক্ষাপট: পিচের প্রতিকূলতা বোলারদের ঝড়

ম্যাচ শুরুর আগে থেকেই ধারণা ছিল, উইকেটে ছিল ঘাসের ছোঁয়া নতুন বলে বাড়তি মুভমেন্ট। আবহাওয়া ছিল মেঘলা, যা বলের সুইং বাড়িয়ে দেবে এটা তো জানা কথাই। টস জিতে প্রতিপক্ষ অধিনায়ক তাই বিন্দুমাত্র দেরি না করে বোলিং নেন। তাদের পরিকল্পনা ছিল পরিষ্কার প্রথম দুই ঘণ্টায় প্রতিপক্ষকে ভেঙে ফেলা।

এ পরিকল্পনা সত্যি হতে বেশি সময় নেয়নি। বাংলাদেশের ওপেনাররা শুরু থেকেই ছিলেন চাপে। প্রথম চার ওভারের মধ্যেই দুটি উইকেট পড়ে যায়, প্রতিটি উইকেটই যেন বাড়তি চাপ তৈরি করে। কেউই মুভিং বল সামলাতে পারছিলেন না ব্যাটে-বলে কোনও আত্মবিশ্বাস খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। হঠাৎ মনে হচ্ছিল ২০০ রানও কি হবে কিন্তু গল্পের মূল নায়ক তখনও ক্রিজে আসেননি।

জিল্লুরের আগমন: নীরবতা ভেঙে ব্যাটের ভাষা

৪/২ স্কোরবোর্ডে গর্জন তুলছে বোলাররা। ঠিক তখনই নামেন জিল্লুর রহমান। তাঁর মুখে কোনও উৎকণ্ঠা নেই, কোনও বাড়তি আবেগ নেই। অফ স্টাম্পের বাইরে বাড়তি দূরত্ব পরীক্ষা করতে থাকা পেসারদের চোখে তিনি যেন নতুন এক চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিলেন আমি আছি, দেখে নাও।

প্রথম ৩০ বল খেললেন মাত্র ৬ রান করে। বাইরের লোকদের কাছে এটি হয়তো ‘ধীর’ ইনিংস, কিন্তু আসলে সেটিই ছিল বুদ্ধিমানের খেলা। প্রতিটি বল বিচার করছেন, প্রতিটি ডেলিভারির পর ব্যাট ঠিক মেলে ধরে বলকে থামাচ্ছেন, উইকেট রক্ষা করছেন, সময় নিচ্ছেন, পিচ বুঝছেন।

এ ইনিংসের শুরুটা যেন কোনো অভিজ্ঞ ব্যাটসম্যানের কৌশলময় রঙে আঁকা। তবে সে সময় টিম ম্যানেজমেন্ট থেকে শুরু করে ড্রেসিংরুম পর্যন্ত সবাই জানতেন আজ জিল্লুরের দিন হতে পারে। গত কয়েক ম্যাচ ধরে তিনি শুরুটা ভালো করলেও বড় রানে রূপ দিতে পারছিলেন না। বিশেষ করে, ৭৪, ৬১, ৮২-এমন কিছু ইনিংস ছিল, যা তাকে সেঞ্চুরির বারান্দায় নিয়ে গেছে, কিন্তু ভেতরে ঢুকতে দেয়নি।তাই আজকের দিনটা তাঁর কাছে ছিল নিজের কাছে নিজের প্রমাণ দেওয়ার সময়।

বোলারদের দাপট ভেদ করে স্থির পদক্ষেপ

প্রথম ১৫ ওভারে ব্যাটারদের উপর ছিল অস্থিরতা, ভয়, অনিশ্চয়তা। কিন্তু জিল্লুরের ব্যাট শুধু বল ঠেকাচ্ছিল না ধীরে ধীরে প্রতিরোধের দেয়ালও গড়ে তুলছিল।

প্রতিপক্ষ পেসাররা যখন ছোট লেংথে আক্রমণ করছিল, তখন তিনি নিয়ন্ত্রণ রেখে খেললেন পুল শট। যখন ফুল লেংথে জোরে বল আসছিল, তখন খেললেন কভার ড্রাইভ। তাঁর ব্যাটিং ধ্যানধারণায় আজ ছিল এক ধরনের মরমী স্থিরতা যেন ইটের পর ইট সাজিয়ে তিনি নিজের এক রাজপ্রাসাদ তৈরি করছেন।

আরো পড়ুন : বাংলাদেশ আয়ারল্যান্ড প্রথম টি টোয়েন্টিটসে জিতে ফিল্ডিংয়ে বাংলাদেশ

একসময় যখন পেসাররা ব্যর্থ হতে শুরু করল, তখন আসে স্পিন আক্রমণ। কিন্তু স্পিনাররাও আজ কোনও বড় ক্ষতি করতে পারেনি। শুরুর দিকে তিনি পা ব্যবহার করে বলকে ভেতর থেকে পড়ছেন, পরে বাউন্স কম হলে কাট শট খেললেন, আবার যখন বল টার্ন করল, তখন স্টেপ আউট করে দেখিয়ে দিলেন ক্রিজ শুধু দাঁড়ানোর জায়গা নয়, এটি ব্যাটসম্যানের যুদ্ধক্ষেত্র।

অর্ধশতকের পথে দুর্দান্ত নিয়ন্ত্রণ

জিল্লুরের হাফ-সেঞ্চুরিটি ছিল ক্রিকেটীয় সৌন্দর্যের এক নিদর্শন। তাঁর ৫০ পূর্ণ হয় ৯৬ বলে শুনতে ধীর মনে হলেও, ম্যাচের পরিস্থিতি বিবেচনায় এটি ছিল ক্যারিয়ার-গঠনকারী ইনিংসের মতোই পরিমিত ও প্রয়োজনীয়।পাঁচটি মার্জিত চার, দুটি ঝুঁকিমুক্ত ছয় ব্যাটিং ছিল সুবিন্যস্ত।

দল তখন ১০৭/৪, এবং ড্রেসিংরুমে ইতোমধ্যেই নতুন এক বিশ্বাস তৈরি হতে শুরু করে আজ কিছু হচ্ছে।

সঙ্গীহীন লড়াই নয় পার্টনারশিপের গল্প

ক্রিকেট একা খেলার খেলা নয়। জিল্লুরও পেয়েছেন প্রয়োজনীয় সঙ্গ। বিশেষ করে, পঞ্চম উইকেটে মাহিরের সঙ্গে তাঁর ৮৩ রানের জুটি ছিল ম্যাচ পাল্টানো মুহূর্ত। মাহিরের শান্ত ব্যাটিং জিল্লুরকে অভয় দিয়েছিল আক্রমণে অবদান রাখতে।

এই জুটির সময় জিল্লুর গিয়ার বদলান। ১০ থেকে ৩০ ওভারের মধ্যে তিনি খেলেন আরও স্বাধীনভাবে ড্রাইভ, ফ্লিক, কাট প্রতিটি শটেই ছিল আত্মবিশ্বাসের প্রকাশ।

সেঞ্চুরির দিকে এগোনো: মাঠে নীরব উত্তেজনা

যখন তিনি ৯০ পার করলেন, পুরো গ্যালারি এক অদ্ভুত নীরব প্রত্যাশায় ডুবে যায়। কমেন্ট্রি বক্সে বারবার উচ্চারিত হচ্ছিল
“এটাই কি সেই দিন? জিল্লুরের প্রথম আন্তর্জাতিক সেঞ্চুরি ।

বোলাররাও জানত এই ব্যাটারকে চাপে ফেলতেই হবে।
তাই লাইন-লেংথ আরও কঠোর, আরও সোজা, আরও ধারালো।

কিন্তু এমন দিনে বোধহয় ভাগ্যও সাহসীদের সঙ্গ দেয়।
৯৯ রানে থাকাকালে স্পিনারের লেগ-কাটারে তিনি বড় শট খেলেন। বল উড়তে থাকে মিডউইকেটের ওপর দিয়ে, গ্যালারিতে শ্বাস রোধ হয়ে আসে, আর বল বাউন্ডারি অতিক্রম করতেই উল্লাসের ঝড়।

জিল্লুর রহমান অবশেষে পেলেন তাঁর বহু প্রতীক্ষিত প্রথম আন্তর্জাতিক সেঞ্চুরি!

সেঞ্চুরির পর চোখে জল, আকাশের দিকে তাকানো

সেঞ্চুরি করার পর তাঁর প্রতিক্রিয়া ছিল রীতিমতো আবেগমাখা।
গ্লাভস খুলতে খুলতে তিনি দু’হাত তুলে আকাশের দিকে তাকালেন। চোখ দুটো চিকচিক করছিল মনে হচ্ছিল, এ সেঞ্চুরির পেছনে রয়েছে লম্বা পথচলা, ত্যাগ, পরিশ্রম, আঘাত, চাপ, ব্যর্থতা সবকিছুর এক সোনালি প্রতিফলন।

টিভি ক্যামেরা জুম করলে দেখা যায় জিল্লুর চুপচাপ নিজের ব্যাট টোকা দিয়ে কিছু বললেন, সম্ভবত নিজের মা-বাবার জন্য, নিজের দীর্ঘদিনের কোচের জন্য, অথবা সেই ছোটবেলার নিজের জন্য, যে স্বপ্ন দেখেছিল জাতীয় দলে খেলার।

ইনিংসের শেষ: দলকে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যাওয়া

সেঞ্চুরির পরে তিনি থেমে যাননি। দল তখনো নিরাপদ নয়। তাই দায়িত্বশীল ব্যাটসম্যানের মতোই তিনি আরও রান তুললেন।শেষ পর্যন্ত ১৪৮ রানে আউট হওয়া পর্যন্ত তিনি খেললেন ২০৩ বল যার মধ্যে ১৭টি চার এবং ৩টি ছয় ছিল।তাঁর ইনিংসের বদৌলতে দল দাঁড়ায় ২৯৬ রানে যা এই পিচে প্রায় ম্যাচ জেতানোর মতো স্কোর।

দিনশেষে বিশ্লেষণ: কেন এই ইনিংসটি এত গুরুত্বপূর্ণ?

এই ইনিংস শুধু প্রথম সেঞ্চুরি নয়এটি তিনটি কারণে ঐতিহাসিক:

  1. চাপের ম্যাচে সেরা পারফরম্যান্স:
    দল যখন ব্যর্থ, তখন তিনি দাঁড়ালেন। ম্যাচের স্রোত বদলে দিলেন।
  2. প্রতিটি শট ছিল পরিকল্পনা অনুযায়ী:
    কোনও বেপরোয়া ব্যাটিং নয় শতভাগ ক্রিকেটীয় শৃঙ্খলা।
  3. দলে আত্মবিশ্বাস ফেরানো:
    টানা ব্যর্থতার পর আজকের ব্যাটিং দলকে এক নতুন আলো দেখালো।
শেষ কথা: নতুন নায়কের উদয়

আজকের পারফরম্যান্সে স্পষ্ট হয়ে গেছে বাংলাদেশ ক্রিকেট একটি নতুন নায়ক পেতে যাচ্ছে।
জিল্লুর শুধু রানের পাহাড় নয়, প্রয়োজন হলে দায়িত্ব নিতেও জানেন। তাঁর ব্যাটিংয়ের পরিপক্বতা দৃঢ়তা এবং বিপদের দিনে লড়াইয়ের মানসিকতা তাঁকে আলাদা করে তুলেছে।

ক্রিকেট এমন গল্পই ভালোবাসে বোলারদের দাপটের দিনে, যখন কেউ টিকে থাকতে পারে না, তখন এক ব্যাটসম্যান নীরবে লিখে যায় নিজের ইতিহাস।আজ সেই নীরব ইতিহাসের লেখক জিল্লুর রহমান ।

সর্ম্পকিত পোস্ট

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisement -

সর্বশেষ নিউজ