কৃষিকে কেবল খাদ্য উৎপাদনের ক্ষেত্র নয়, বরং কর্মসংস্থান ও আয় বৃদ্ধির অন্যতম চালিকাশক্তি হিসেবে গড়ে তুলতে ২০৩০ সালের মধ্যে কৃষি ব্যবসা খাতে বার্ষিক বিনিয়োগ দ্বিগুণ করে ৯ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করার ঘোষণা দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। সংস্থাটির প্রেসিডেন্ট অজয় বাঙ্গা বলেছেন, কৃষিকে এখন এমন এক ব্যবসায়িক শক্তিতে রূপান্তর করা দরকার, যা ক্ষুদ্র কৃষকদের আয় বাড়াবে এবং নতুন অর্থনৈতিক সুযোগ সৃষ্টি করবে।
কৃষি হবে অর্থনীতির পরবর্তী প্রবৃদ্ধির ইঞ্জিন
২০২৫ সালের বার্ষিক সভার অ্যাগ্রি-কানেক্ট ফ্ল্যাগশিপ ইভেন্টে বক্তব্য রাখেন বিশ্বব্যাংক গ্রুপের প্রেসিডেন্ট অজয় বাঙ্গা। তিনি বলেন, “আজকের চ্যালেঞ্জ কেবল বেশি খাদ্য উৎপাদন নয়, বরং সেই প্রবৃদ্ধিকে এমন এক ব্যবসায়িক মডেলে রূপান্তর করা, যা আয় ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে।”
বাঙ্গা উল্লেখ করেন, আগামী ১০ থেকে ১৫ বছরের মধ্যে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে প্রায় ১.২ বিলিয়ন তরুণ কর্মজীবনে প্রবেশ করবে, অথচ বর্তমান ধারা অনুযায়ী কর্মসংস্থান তৈরি হবে মাত্র ৪০০ মিলিয়ন। এই ঘাটতি বিশ্ব অর্থনীতিকে এগিয়ে নেওয়ার সুযোগ তৈরি করতে পারে, আবার অস্থিরতার ঝুঁকিও বাড়াতে পারে।
কর্মসংস্থানই বিশ্বব্যাংকের মূল লক্ষ্য
বাঙ্গা বলেন, “কর্মসংস্থান সৃষ্টি এখন বিশ্বব্যাংক গ্রুপের মূল মিশন।”
এ লক্ষ্যে সংস্থাটি তিনটি স্তম্ভের ওপর কাজ করছে—
১️⃣ অবকাঠামো ও দক্ষতা উন্নয়ন
২️⃣ ব্যবসাবান্ধব নীতিমালা ও পরিবেশ সৃষ্টি
৩️⃣ বিনিয়োগকারীদের ঝুঁকি কমাতে সহায়তা
তিনি আরও বলেন, “কর্মসংস্থান শেষ পর্যন্ত বেসরকারি খাত থেকেই আসে, তবে অর্থনৈতিক যাত্রার শুরুতে সরকারি খাতই পথ দেখায়।”
ক্ষুদ্র কৃষক হবে পরিবর্তনের কেন্দ্রবিন্দু
বিশ্বব্যাংক ৫টি খাতকে কর্মসংস্থানের প্রধান উৎস হিসেবে চিহ্নিত করেছে—অবকাঠামো, কৃষি ব্যবসা, স্বাস্থ্যসেবা, পর্যটন ও মূল্যসংযোজন শিল্প। এর মধ্যে কৃষি ব্যবসাকে সবচেয়ে সম্ভাবনাময় খাত হিসেবে দেখা হচ্ছে। এটি যেমন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে, তেমনি বৈশ্বিক খাদ্য চাহিদা ৫০ শতাংশ বাড়ার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায়ও ভূমিকা রাখবে।
অজয় বাঙ্গা বলেন, উদীয়মান অর্থনীতিগুলিই এই পরিবর্তনের কেন্দ্রে থাকবে।
- আফ্রিকায় বিশ্বের ৬০% অনাবাদি আবাদযোগ্য জমি রয়েছে।
- লাতিন আমেরিকা ইতোমধ্যে এক বিলিয়নের বেশি মানুষের খাদ্য উৎপাদন করছে।
- এশিয়ায় ক্ষুদ্র কৃষকরাই জমির মালিক; প্রযুক্তি, অর্থায়ন ও বাজারে প্রবেশাধিকার বাড়াতে পারলে বিশাল পরিবর্তন সম্ভব।
বর্তমানে বিশ্বের মোট খাদ্যের ৮০% উৎপাদন করেন ৫০০ মিলিয়ন ক্ষুদ্র কৃষক, কিন্তু তাঁদের মধ্যে ১০ শতাংশেরও কম বাণিজ্যিক অর্থায়নের আওতায় রয়েছে।
আরো পড়ুন: ভারতের বাজারে সোনার দাম কমার আশঙ্কা রয়েছে: জানালেন কামাখ্যা জুয়েলসের সহ-প্রতিষ্ঠাতা মনোজ ঝা
কৃষকদের সহায়তায় নতুন কৌশল
বিশ্বব্যাংকের নতুন কৌশল তিনটি লক্ষ্যে কেন্দ্রিত—
- ক্ষুদ্র কৃষকের উৎপাদনশীলতা ও পরিসর বৃদ্ধি
- তাদের মূল্য শৃঙ্খলের সঙ্গে সংযুক্ত করা
- অর্থায়ন, বিমা ও বাজারে প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা
বাঙ্গা বলেন, “সহনশীলতা শুরু থেকেই অন্তর্ভুক্ত করতে হবে—তাপ সহনশীল বীজ, উন্নত সেচব্যবস্থা, মাটির পুনরুজ্জীবন ও বিমা কাঠামো এমনভাবে গড়ে তুলতে হবে, যাতে খারাপ মৌসুম মানেই ক্ষতির বছর না হয়।”
ডিজিটাল প্রযুক্তিই হবে কৃষির আঠা
ডিজিটাল প্রযুক্তিকে “পুরো ব্যবস্থার আঠা” হিসেবে উল্লেখ করেন অজয় বাঙ্গা। তাঁর মতে, ছোট এআই-নির্ভর টুল ব্যবহার করে ফসলের রোগ শনাক্ত করা, সার প্রয়োগের পরামর্শ দেওয়া, আবহাওয়া সতর্কতা পাঠানো এবং নিরাপদ ডিজিটাল পেমেন্ট সম্পন্ন করার মতো সুযোগ তৈরি হচ্ছে।
“ডিজিটালই সেই শক্তি, যা পুরো ব্যবস্থাকে একত্রে ধরে রাখে,” বলেন বাঙ্গা।
পরীক্ষিত মডেল ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
ভারতের উত্তর প্রদেশে এই মডেল ইতিমধ্যেই সফলভাবে কার্যকর হয়েছে বলে জানান তিনি। তাঁর ভাষায়, “এটি শুধু কার্যকর নয়, বরং সম্প্রসারণযোগ্যও।”
তিনি বলেন, “এই রূপান্তর তখনই সফল হবে, যখন সরকার, ব্যবসা ও উন্নয়ন অংশীদাররা একসঙ্গে কাজ করবে। আমরা সবাই যদি একই দিকে বৈঠা চালাই, তাহলেই সাফল্য সম্ভব।”
বিশ্বব্যাংকের নতুন কৃষি-কেন্দ্রিক কৌশল ইঙ্গিত দিচ্ছে—ভবিষ্যতে কৃষি আর কেবল খাদ্য নিরাপত্তার মাধ্যম নয়, বরং অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থানের মূল ইঞ্জিনে পরিণত হতে পারে।