ইতালির ফুটবল যেন এক গভীর সংকটের ভেতর হারিয়ে গেছে। এক সময় যারা ছিল বিশ্ব ফুটবলের নন্দনকানন, সেই দেশই এখন টানা তৃতীয়বারের মতো বিশ্বকাপে না খেলার আশঙ্কায়। প্রশ্ন উঠছে-চারবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ইতালির ফুটবলে কি তবে স্থায়ী মন্দা নেমে এসেছে?
টালমাটাল ইতালির বর্তমান অবস্থা
২০২৬ সালের বিশ্বকাপ বাছাইয়ে ইউরোপীয় অঞ্চলের ‘আই’ গ্রুপে ইতালি রয়েছে দ্বিতীয় স্থানে। ৪ ম্যাচে তাদের সংগ্রহ ৯ পয়েন্ট। শীর্ষে থাকা নরওয়ের পয়েন্ট ১৫ (৫ ম্যাচে), আর সমান ৯ পয়েন্ট নিয়ে তৃতীয় স্থানে ইসরায়েল। ফলে আসছে এস্তোনিয়া ও ইসরায়েলের বিপক্ষে দুটি ম্যাচ ইতালির জন্য বাঁচা-মরার লড়াই হয়ে দাঁড়িয়েছে। কাঙ্ক্ষিত ফল না এলে, ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটতে পারে-আরও একবার বিশ্বকাপের বাইরে থেকে যেতে পারে ইতালি।
সংকটের শিকড় ২০০৬-এর কেলেঙ্কারিতে
ইতালির ফুটবলের পতনের গল্প শুরু হয় ২০০৬ সালে ‘ক্যালসিওপোলি’ কেলেঙ্কারি দিয়ে। জুভেন্টাস, এসি মিলান, ফিওরেন্তিনা, লাৎসিও, রোমা-সব বড় ক্লাব জড়িয়ে পড়ে ম্যাচ ফিক্সিংয়ে। যদিও সেই বছরই ইতালি বিশ্বকাপ জিতে সাময়িকভাবে সংকট ঢেকে দেয়, কিন্তু ক্ষত তখনই গভীরে গিয়েছিল।
এরপর ২০১০ সালে উয়েফার ফাইন্যান্সিয়াল ফেয়ার প্লে নিয়ম চালুর পর আর্থিক সংকটে পড়ে দেশটির বড় ক্লাবগুলো। সিরি ‘আ’র মান কমতে থাকে, ইউরোপে ইতালিয়ান ক্লাবগুলোর প্রভাব হারিয়ে যায়। এর সরাসরি প্রভাব পড়ে জাতীয় দলে। ২০১০ ও ২০১৪ বিশ্বকাপে গ্রুপ পর্ব থেকেই বিদায়, আর ২০১৮ ও ২০২২ সালে বাছাইপর্বই পেরোতে পারেনি আজ্জুরিরা।
রক্ষণে ঐতিহ্য, আক্রমণে ব্যর্থতা
ইতালির রক্ষণভাগ এখনো বিশ্বমানের নাম দেখেছে-বুফন, দোন্নারুম্মা, বোনুচ্চি, কিয়েল্লিনি। কিন্তু আক্রমণভাগে তেমন নাম পাওয়া যায়নি রসি, বাজ্জো, টট্টি, দেল পিয়েরো কিংবা ইনজাগির পর। বর্তমানে দলের ভরসা মাতেও রেতেগুই বা মইসে কিন-যাদের পারফরম্যান্স অনিয়মিত, ধারাবাহিক নয়।
ফুটবলের দর্শনে পরিবর্তন, প্রতিভার ক্ষয়
ইতালিয়ান বিশ্লেষক ম্যাসিমো ফ্রাঞ্চির মতে, সমস্যার শিকড় আরও গভীরে। তিনি বলেন,
আমি তুরিনে আট বছরের শিশুদের ম্যাচ দেখেছিলাম। এক ড্রিবলার ছেলেকে বদলি নামানো হয়, সে বল হারালে কোচ চিৎকার শুরু করে। আমরা ছোট বয়স থেকেই ভয় শেখাচ্ছি। রক্ষণভিত্তিক সংস্কৃতি এখন এক প্রজন্মের সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
‘কাতেনাচ্চিও’ কৌশল একসময় ইতালিকে দিয়েছে মালদিনি ও বারোসির মতো রক্ষণশিল্পী। কিন্তু এই রক্ষণমুখী দর্শনের কারণে আক্রমণভাগ বিকশিত হয়নি। প্রতিভাবান তরুণরা ক্লাব পর্যায়ে খুব তাড়াতাড়ি ছাঁচে ঢালা হয়, ফলে সৃজনশীলতা নষ্ট হয়ে যায় আগেভাগেই।
ফরোয়ার্ডের অভাব ও বিদেশিদের দাপট
গত ১৫ বছরে ইতালির সম্ভাবনাময় ফরোয়ার্ডরা কেউই ধারাবাহিক সাফল্য আনতে পারেননি। গিউসিপ্পে রসি, মারিও বালোতেল্লি, ইনসিনিয়ে, কিয়েসা, ইম্মোবিলে-সবাই একসময় আলোচনায় ছিলেন, কিন্তু কারও আলো স্থায়ী হয়নি। ইনসিনিয়ে, কিয়েসা, ইম্মোবিলে ইউরো ২০২০ জয়ী দলের সদস্য হলেও সেই সাফল্য জাতীয় ফুটবলে নতুন দিগন্ত আনতে পারেনি।
গত দশকে মাত্র দুজন ইতালীয় ফুটবলার সিরি ‘আ’তে সর্বোচ্চ গোলদাতা হয়েছেন—চিরো ইম্মোবিলে ও ফাবিও কোয়াগলিয়ারেলা। ফ্রাঞ্চির মতে, স্থানীয় ক্লাবগুলোতে বিদেশি খেলোয়াড়ের আধিক্য তরুণ ইতালীয়দের বিকাশ বাধাগ্রস্ত করছে।
নাগরিকত্ব প্রাপ্তদের দলে ঠাঁই
জাতীয় দলেও এখন বিদেশি বংশোদ্ভূত খেলোয়াড়দের সংখ্যা বাড়ছে। লুইজ ফেলিপে, জোয়াও পেদ্রো, জর্জিনিও, এমারসন, রাফায়েল তোলোই-সবাই ব্রাজিলীয় বংশোদ্ভূত। ২০১০ সালে ইন্টার মিলান যখন চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতে, তখন তাদের প্রথম একাদশে একজনও ইতালীয় খেলোয়াড় ছিল না। জাতীয় দলও যেন একই পথে হাঁটছে।
আরো পড়ুন:জয়সোয়াল-গিলের সেঞ্চুরির পর ভারতীয় বোলারদের দাপট: চাপে ওয়েস্ট ইন্ডিজ
গাত্তুসোর হাতে নতুন সূচনার আশায়
বর্তমান কোচ জেনারো গাত্তুসোর ওপর এখন ভরসা রাখছে ইতালির ফুটবল মহল। তবে সমালোচকরা মনে করেন, গাত্তুসোর কোচিংয়ে এখনো দৃঢ় দর্শন তৈরি হয়নি। বিশ্লেষক ফ্রাঞ্চির মতে,
গাত্তুসোর হৃদয় বিশাল, কিন্তু সীমাবদ্ধতা আছে। তিনি আনচেলত্তি বা ক্যাপেলো নন, বরং ছায়া-প্রশিক্ষক।
শেষ পর্যন্ত কি ফিরবে ‘আজ্জুরিদের’ জৌলুস?
সম্ভবত এবার কোনোভাবে ইতালি বিশ্বকাপের টিকিট পেয়ে যাবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো ইতালিয়ান ফুটবল এখনো এক অন্ধকার টানেলের মধ্যে, যেখানে আলো দেখা এখনো অনেক দূরের পথ।