পৃথিবীর কোন দেশে শুধু সরকারি কর্মচারীদের জন্য ব্যাংক গঠনের কোন নজির নেই। কিন্তু সেই পথে হাটার চিন্তা করছে বাংলাদেশ। দেশের সেনাবাহিনী, বিজিবি, পুলিশ ও আনসার-ভিডিপির জন্য আলাদা ব্যাংক রয়েছে। এখন সরকারি কর্মচারীদের ব্যাংকের লাইসেন্সে এর কথা চলছে। প্রাথমিকভাবে এই ব্যাংকটির একটি নামও দেওয়া হয়েছে। নাম হলো ‘সরকারি কর্মচারী ব্যাংক’।
সরকারি কর্মচারীদের জন্য আলাদা ব্যাংকের প্রস্তাব
বর্তমানে সেনাবাহিনী, বিজিবি, পুলিশ ও আনসার-ভিডিপির নিজস্ব ব্যাংক রয়েছে। এবার প্রায় ২০ লাখ সরকারি কর্মচারীর জন্য একই ধরনের একটি ব্যাংক প্রতিষ্ঠার বিষয়টি আলোচনায় এসেছে। বেতন কমিশনের সদস্যদের মতে, সরকারি কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বাবদ প্রতিবছর এক লাখ কোটি টাকার কাছাকাছি অর্থ ব্যয় হয়। ফলে তাঁদের জন্য একটি নির্দিষ্ট ব্যাংক থাকলে অর্থ ব্যবস্থাপনা আরও সহজ হবে।
কমিশনের সভাপতি ও সাবেক অর্থসচিব জাকির আহমেদ খান জানিয়েছেন, “সরকারি কর্মচারীদের জন্য ব্যাংক গঠনের ব্যাপারে আলোচনা চলছে। প্রতিবেদন জমা দেওয়ার সময় এ সুপারিশ থাকতে পারে, আবার নাও থাকতে পারে।”
ফরাসউদ্দিন কমিশনের পুরোনো প্রস্তাবের পুনরাবৃত্তি
এ ধারণা নতুন নয়। এর আগে ২০১৪ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনের নেতৃত্বাধীন জাতীয় বেতন কমিশনও সরকারি কর্মচারীদের জন্য ব্যাংক গঠনের প্রস্তাব দিয়েছিল। তখন ব্যাংকটির নাম প্রস্তাব করা হয়েছিল ‘সমৃদ্ধির সোপান ব্যাংক’, যার প্রাথমিক মূলধন নির্ধারণ করা হয়েছিল ৪০০ কোটি টাকা। তবে সেই উদ্যোগ পরে আর এগোয়নি।
ব্যাংক গঠনের পক্ষে যুক্তি
বেতন কমিশনের প্রভাবশালী সদস্যরা মনে করেন, সরকারি কর্মচারীদের একটি নির্দিষ্ট ব্যাংক থাকলে তাঁদের আর্থিক সেবা পাওয়া সহজ হবে। চাকরির বদলি হলে ইলেকট্রনিক ফান্ড ট্রান্সফার (EFT)–এর জটিলতা কমবে, বেতন পেতে বিলম্ব হবে না। এছাড়া সন্তানদের পড়াশোনা, বিয়ে বা গৃহনির্মাণের জন্য স্বল্পসুদে ঋণ দেওয়ার ব্যবস্থাও থাকতে পারে এই ব্যাংকে।
আরো পড়ুন:
আগামীকালের আবহাওয়া ২৭ অক্টোবর ২০২৫
দুবাই আজকের সোনার দাম ২৬ অক্টোবর ২০২৫
বিদ্যমান ব্যাংকগুলোকেই শক্তিশালী করার পরামর্শ
তবে অনেকে এই প্রস্তাবকে অপ্রয়োজনীয় ও অকার্যকর বলে মনে করছেন। অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদ বলেন,
“দুনিয়ার কোথাও সরকারি কর্মচারীদের জন্য আলাদা ব্যাংক নেই। দেশে ব্যাংকের সংখ্যা আগেই বেশি। নতুন ব্যাংক করার চিন্তা বাদ দিয়ে সরকারের উচিত বিদ্যমান ব্যাংকগুলোর কার্যক্রম উন্নত করা।”
বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারাও জানিয়েছেন, সরকারি কর্মচারীদের জন্য আলাদা ব্যাংক প্রতিষ্ঠার কোনো আন্তর্জাতিক নজির নেই।
রাজনৈতিক প্রভাব ও ব্যাংক খাতের সংকট
বর্তমানে দেশে ৬১টি তফসিলি ব্যাংক আছে, যার মধ্যে ৬টি রাষ্ট্রমালিকানাধীন। আওয়ামী লীগ সরকারের সময় রাজনৈতিক বিবেচনায় বেশ কিছু ব্যাংকের লাইসেন্স দেওয়া হয়েছিল, যার মধ্যে আছে আনসার-ভিডিপি উন্নয়ন ব্যাংক (১৯৯৬), ট্রাস্ট ব্যাংক (১৯৯৯), সীমান্ত ব্যাংক (২০১৬) এবং কমিউনিটি ব্যাংক (২০১৯)। তবে রাজনৈতিক প্রভাবে গঠিত অনেক ব্যাংকে অনিয়ম ও লুটপাটের অভিযোগ উঠেছে, যার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে পুরো ব্যাংক খাতে।
নতুন ব্যাংক নাকি পুরোনো ব্যাংকের পুনর্গঠন?
বেতন কমিশনের অভ্যন্তরীণ আলোচনায় জানা গেছে, কেউ কেউ প্রস্তাব দিয়েছেন—নতুন ব্যাংক গঠনের বদলে বিদ্যমান কোনো দুর্বল ব্যাংককে পুনর্গঠন করে ‘সরকারি কর্মচারী ব্যাংক’ নামে রূপান্তর করা যেতে পারে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের সচিব নাজমা মোবারেক অবশ্য এ বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নতুন ব্যাংক গঠন করা হলে তা সরকারি খাতে আরেকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান যোগ করবে, কিন্তু বাস্তবিক প্রভাব নির্ভর করবে এর ব্যবস্থাপনা ও দক্ষতার ওপর। তবে বিশ্বে নজিরবিহীন এই উদ্যোগ কতটা কার্যকর হবে, তা সময়ই বলে দেবে।

